তিন উইকেটে জিতে ফাইনালে রোহিতদের মুখোমুখি অস্ট্রেলিয়া
গ্রস আইলেটের সঙ্গে ইডেন গার্ডেনসের চিত্রনাট্যে প্রচুর মিল!
ষোল বছর আগে এমনই দ্বিতীয় সেমিফাইনালে টস জিতে সাউথ আফ্রিকার অধিনায়ক গ্রেম স্মিথ ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকা দুরন্ত দল তখন। অধিনায়ক স্মিথ ছাড়াও এবি ডিভিলিয়ার্স, জ্যাক কালিস, হারশেল গিবস, মার্ক বাউচাররা দলে। কিন্তু গ্লেন ম্যাকগ্রাথ (৩/১৮) এবং শন টেটের (৪/৩৯) সামনে অসহায় আত্মসমর্পণ করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা, মাত্র ১৪৯ রানে ইনিংস শেষ করে। সর্বোচ্চ রান করেছিলেন অ্যান্ড্রু হল, অপরাজিত ৪৯, আর গিবসের ৩৯। অস্ট্রেলিয়া হাসতে হাসতে ৩ উইকেট হারিয়ে ফাইনালের ছাড়পত্র জোগাড় করেছিল, ১১১ বল বাকি থাকতে। ১৯৯৯ সেমিফাইনালের টাই তখন শুধুই স্মৃতিতে।
আরও ষোল বছর পর ইডেনে টস জিতলেন তেম্বা বাভুমা। মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়ায় প্রথমে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত একই রকম বুমেরাং। ১৪ ওভার শেষে বৃষ্টি এসে প্রথম যখন খেলা বন্ধ করল, বাভুমাদের বোর্ডে ৪৪ রান, চার উইকেট হারিয়ে। অধিনায়ক নিজে শূন্য রানেই ফিরেছিলেন, পরে ডে কক (৩), মার্করাম (১০) ও ফন ডার ডুসেন (৬)। মিচেল স্টার্ক ও জস হ্যাজলেউডের সংগ্রহে দুটি করে উইকেট। বাভুমার সাউথ আফ্রিকা কালিসদের ১৪৯ পেরতে পারবে কিনা জেনে নেওয়া ছাড়া, অস্ট্রেলিয়ার আহমেদাবাদে পৌঁছনো নিয়ে সন্দেহের লেশমাত্রও ছিল না!
৪৩ মিনিট খেলা বন্ধ থাকার পর সমীকরণ খানিকটা পাল্টাল ডেভিড মিলার নামক ব্রাত্যজনের রুদ্ধসঙ্গীতে!
সাদা বলের ক্রিকেটে ২৮১ ম্যাচ খেলেছেন, লাল বলে শূন্য! তিনশোর কাছাকাছি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার পরও একটিও টেস্টে সুযোগ পাননি, এমন ক্রিকেটার আর কেউ নেই। মিলারের পর যিনি, কায়রন পোলার্ড ২২৪ আন্তর্জাতিক ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের জার্সি পরেছিলেন। তিতিবিরক্ত মিলার অবশ্য ২০১৮ সালেই প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়ে ফেলেছিলেন। ‘খেলে কী হবে? টেস্ট দলে তো আর ডাক পাব না! এমনকি, এ দলের হয়েও পাঁচদিনের খেলার জন্য নাম বিবেচিত হয় না। তাই চেষ্টাই করিনি আর’, বলেছিলেন সখেদ। সাউথ আফ্রিকার মিডল অর্ডারে তখন সত্যিই ঠাঁই নাই। জ্যাক কালিস, হাসিম আমলা, এবি ডিভিলিয়ার্স, ফাফ দুপ্লেসি। মনঃসংযোগ করেছিলেন সাদা বলের ক্রিকেটে।

ইডেনে সেই ডেভিডের সামনে তখন বাকিরা গোলিয়াথ। একা কুম্ভের ক্লিশে হয়ে-যাওয়া উপমা নয়, প্রায় ‘ম্যাক্সওয়েলসম’ বললেই ঠিক। চতুর্থ উইকেট পড়েছিল ২৪ রানে, ১১.৫ ওভারে। আউট হয়েছিলেন রসি ফন ডার ডুসেন। উইকেটে এসেছিলেন মিলার। জুটি হল হেইনরিখ ক্লাসেনের সঙ্গে, দ্বিতীয় সেমিফাইনালের প্রথম ইনিংসের সেরা। ৯৫ রান উঠল ১৮.৫ ওভারে। একটু বুকে বল পেলেন দক্ষিণ আফ্রিকার বোলাররা। তারপর মিলার তাণ্ডব, যিনি আকাশে বল তুললে তা ‘পার্ক’ পেরিয়েই যায়, সে ইডেন পার্ক হোক বা ইডেন গার্ডেনস!
৭০ বলে পঞ্চাশে পৌঁছনোর পর শতরানে পৌঁছেছিলেন ১১৫ বলে। অর্থাৎ পরের পঞ্চাশের জন্য ৩৫ বল। ইনিংস সাজানো আট বাউন্ডারি এবং পাঁচ ছক্কায়। অ্যাডাম জাম্পাকে নিয়ে ছেলেখেলা করলেন ফাইনালের আগে, ভারতের বিরুদ্ধে কী হতে পারে আভাস যেন! ক্রিকেটে এমন ইনিংসই পারে নিরপেক্ষ দর্শককে সমর্থক করে তুলতে। নিজেদের জীবনের রোজকার লড়াইটা মাঠে এভাবে দেখে আত্মীয়তা অনুভব করে মানুষ। বিরতির আগে ৪৫ হাজার ৮৫০ দর্শকের করতালির মধ্যেই বিদায় শেষ পর্যন্ত ডিপ স্কোয়ার লেগে ট্র্যাভিস হেডের হাতে ধরা পড়ে। সাউথ আফ্রিকা ততক্ষণে গ্রস আইলেট ভুলিয়ে ২০০-র সীমানাও টপকেছে। শেষে কাগিসো রাবাদার ছয়ে অস্ট্রেলিয়ার সামনে আহমেদাবাদে ভারতের মুখোমুখি হওয়ার লক্ষ্য তখন ২১৩।
টানা সাত ম্যাচ জিতে সেমিফাইনালে উঠে আসা অস্ট্রেলিয়ার কাছে লক্ষ্য বিরাট হওয়ার কথা ছিল না। হয়ওনি প্রধানত হেড-এর কারণে। মাথা ঠিক রেখে ট্র্যাভিস ৪৮ বলে ৬২ করে গেলেন, দলের রান একশো পার করে। বলহাতে এক ওভারে দুই উইকেট এবং দুটি ক্যাচও, ম্যাচের সেরা তিনিই। তারপরের ব্যাপারটা কঠিন করে তোলার চেষ্টায় আন্তরিক ছিলেন শামসি-মহারাজরা। মার্নাস লাবুশানে বেঁচে গেলেন আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্তে। বল উইকেটে লাগছিল জেনেও মাঠের আম্পায়ারের সিদ্ধান্তকেই স্বীকৃতি দিচ্ছে ক্রিকেটের নিয়ম এখন। পরে লাবুশানে আউট হলেন একই রকম। পার্থক্য, এবার মাঠের আম্পায়ার আউট দিয়েছিলেন! ম্যাক্সওয়েলের ১, স্মিথ নিজের বিশ্বকাপ ছন্দহীনতা ধরে রাখায় আর দুরন্ত ইয়র্কারে জশ ইংলিশের স্টাম্প কোয়েটজি ছিটকে দেওয়ায় উত্তেজনার পারদ চড়েছিল। ২১২-র পুঁজি নিয়েও সাউথ আফ্রিকার লড়াই মনে রাখারই মতো। কিন্তু, স্নায়ুচাপ ধরে রাখার শেষখেলায় আবারও জিতে অষ্টমবার ফাইনালে অস্ট্রেলিয়া, দুই ফাস্টবোলারের (স্টার্ক-কামিন্স) ব্যাটে, জয়ের বাউন্ডারি অধিনায়কের, ১৬ বল বাকি থাকতেই।

৪৭ হাজার ৮২৫ জন ইডেনদর্শক হয়ত চেয়েছিলেন ভারতের সামনে ফাইনালে অস্ট্রেলিয়া না হলেই ভাল। পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের যে বিশ্বাস করা যায় না! তাই বুধবারের শামি-ফাইনালের পর বৃহস্পতিবার শামসি-ফাইনাল দেখতে আগ্রহী ছিলেন।
১১ নভেম্বর ১৯৯১ প্রথম শাপমুক্তি ঘটেছিল সাউথ আফ্রিকার, এই ইডেনে। বর্ণবৈষম্য পেরিয়ে প্রত্যাবর্তন ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক আসরে। বত্রিশ বছর পরের নভেম্বরে বিশ্বকাপের পঞ্চম সেমিফাইনালেও হার অবশ্য ঘোষণায় সোচ্চার – সে দেশে শ্বেতাঙ্গ শাসকদের অন্যায় আজও ক্ষমা করেনি ক্রিকেট। তাই ৪২তম ওভারে বোল্ড হয়েছিলেন বটে স্টার্ক, কিন্তু, ফ্রিহিটে!
5 Responses
দারুন ঝরঝরে লেখা । মিলার এর উপমা টাও ভাল। শুধু দর্শক সংখ্যা দু জায়গায় দু রকম দেখলাম।
প্রথমটা বিরতির সময়ের, পরেরটা ম্যাচ শেষ হওয়ার আগে 🙂
সেটাই ভাবছিলাম। মানে যত সময় গেছে দর্শক বেড়েছে।
স্যার! এক কথায় অসাধারণ প্রতিবেদন, একদিকে যেমন শক্তিশালী মেসি আপনার কলমে প্রতিফলিত হয়, তেমনই ব্রাত্য মিলারও শতরানের ট্রাজিক নায়ক হয়ে ওঠেন
পড়েছেন, মন্তব্য করেছেন, অজস্র ধন্যবাদ 🙏