নিঃসঙ্গ, অভিমানী, বঞ্চিত…

কাশীনাথ ভট্টাচার্য

কলকাতা ● ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

তুলসীদাস বলরাম সম্পর্কে একটি গল্প সুপ্রচলিত। গল্পটি শুনিয়েছিলেন সদ্যপ্রয়াত পরিমল দে। যাঁকে বলেছিলেন, সুভাষ ভৌমিক, তিনিও পার্থিব জগত থেকে এত দূরে, আর একবার তাঁর মুখে শোনা সম্ভব নয়। তবু, সুযোগ আছে। কারণ, এই গল্পের কথা সুভাষ ভৌমিক লিখেছিলেন ‘খেলা’ পত্রিকার ১৪০৯ (ইংরেজি ২০০২) সালের পুজোসংখ্যায়। ‘বিতর্ক: শতাব্দীসেরা, ফুটবলে কে?’ বিষয়ে তাঁর লেখার শিরোনাম ছিল, ‘এক নম্বরে বলরাম’। সেই লেখার শেষ অংশ, যা ছাপা হয়েছিল হুবহু —

‘‘পি দে বলছেন, ‘আমার মতে দুজনেই সেরা। দুজনের কাউকেই আমি ছাড়তে পারব না। কেননা, একজন হলেন এমন ফুটবলার যার তুলনা করা যায় বাড়ির ছোট্ট ফুটফুটে শিশুর সঙ্গে। যাকে বাড়ির সবাই ভীষণ ভালবাসে, আদর করে। গোটা বাড়ি মাতিয়ে রাখে সেই শিশুটি। যে না থাকলে বাড়িটা মনে হয় ফাঁকা-ফাঁকা। কেমন ঝিমোনো, নিস্তব্ধ। আর একজন হলেন সেই বাড়ির বৃদ্ধ ভৃত্য, সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রমে যিনি সংসারের সব কিছু সামাল দেন। সেই ছোট্ট শিশু থেকে বাড়ির বয়স্ক কর্তা – প্রত্যেকের ওপর যাঁর সমান নজর। তিনি যদি কোনও দিন বাড়ির বাইরে চলে যান, ছন্দ কেটে যায় সংসারের। গোটা বাড়িটা থমকে যায়। শিশুটি কেঁদে উঠলে দৌড়ে তার সঙ্গে খেলতে যায় না কেউ। বাড়ির গিন্নি খুঁজে পান না হাতের জিনিস। সন্ধ্যায় বাড়ির কর্তা হাত বাড়িয়ে হুঁকো পান না।

ছোট্ট শিশুটি হলেন চুনী গোস্বামী। তুলসীদাস বলরাম হলেন বাড়ির বৃদ্ধ ভৃত্য। আপনি কাকে নেবেন? একজনকে নিতে হলে আমি ভৃত্যটিকেই নেব।’’

সাত এবং আটের দশকের ভারতীয় ফুটবলের ভিডিও-ই পাওয়া যায় না যেখানে, তুলসীদাস বলরামের খেলা দেখার কোনও উপায় আমাদের হাতে ছিল না, নেই। তাই খুঁজে নিতে হয় বিশ্বাসযোগ্য কারও স্মৃতিচারণ, যা পড়ে খানিকটা আভাস পাওয়া যেতে পারে। তাই সুভাষ ভৌমিকের সেই লেখাটাই আবার মনে পড়ে। লিখেছিলেন, ‘খেলতেন নিজের বক্স থেকে বিপক্ষের বক্স পর্যন্ত। বল নিয়ে এবং বল ছাড়া। সে-ই বড় ফুটবলার, যে সময়ে বল ছাড়তে জানে। যে ম্যাচটা গড়তে জানে, সে-ই পারে বল ছাড়া খেলতে। এমন এমন জায়গায় নিজেকে নিয়ে যান, দেখে মনে হবে অনেকদিনের অনুশীলনের ফল হয়ত। আসলে তাঁর ফুটবলবুদ্ধি। বলরামদার এই ফুটবলটা ছাড়াও ছিল ট্যাকেল। ঠিক যখন করার কথা, বলরামদা করতেন তার আগেই। বিপক্ষ ফুটবলার আন্দাজই পেত না। একটা গোল অথবা গোলের বল সাজিয়ে দিয়ে বলরামদা নিজের জায়গায় ফিরে আসতেন মাথা নিচু করে। যেন কিছুই হয়নি। অথবা যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। এর মধ্যে নতুনত্ব কিছু নেই… তাঁর খেলায় চুনী গোস্বামীর জৌলুস হয়ত ছিল না, কিন্তু কার্যকারিতা ছিল তাঁর থেকে অনেক বেশি।’

বলরাম শেষ জীবনে নিজের ইস্টবেঙ্গলি পরিচয়টা মনে রাখতে চাননি। ঘোষণা করেই গিয়েছিলেন, তাঁর মরদেহ যেন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে নিয়ে যাওয়া না হয়। কিন্তু তাঁর সম্পর্কে ইস্টবেঙ্গলি হিসাবে খ্যাত পরিমল আর সুভাষের এই দুটি গল্পের মতো ‘সত্য’ চিনতে সাহায্য করে ফুটবলার বলরামকে।

ইনসাইড লেফট খেলতেন চুনী। একই জায়গা ছিল বলরামেরও। কিন্তু লেফট আউটেও সমান পারদর্শিতা। তাঁর এবং তাঁদের প্রজন্মের মতে সেরা কোচ রহিম সাহেবের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন, সর্বত্র খেলতে পারার গুণে। তাঁকে মাঝমাঠেও খেলিয়েছিলেন কোচ রহিম। তারপরও আন্তর্জাতিক ম্যাচে গোল করেছেন প্রায় নিয়মিত। তখন আন্তর্জাতিক ম্যাচ বিশেষ খেলা হত না। আর বাংলাদেশ-নেপাল-পাকিস্তানকেও পাওয়া যেত না বিপক্ষে। বলরামের উল্লেখযোগ্য আন্তর্জাতিক গোলগুলো দেখুন কোন্ কোন্ প্রতিযোগিতা এবং কাদের বিরুদ্ধে –

● ১৯৫৮ টোকিও এশিয়ান গেমসে ২ গোল যথাক্রমে হংকং ও ইন্দোনেশিয়ার বিরুদ্ধে

● ১৯৫৯ মারদেকা কাপে ১ গোল সিঙ্গাপুরের বিরুদ্ধে

● ১৯৬০ রোম অলিম্পিক্সে ১ গোল হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে

● ১৯৬২ এশিয়ান গেমসে ২ গোল, যথাক্রমে থাইল্যান্ড ও জাপানের বিরুদ্ধে

ভারতীয় ফুটবলের সেরা সাফল্য যদি জাকার্তা এশিয়ান গেমসের সোনা, মেলবোর্ন এবং রোম অলিম্পিক্সের পারফরম্যান্সও সমানভাবে উল্লেখ্য। পরপর দুটি করে এশিয়ান গেমস এবং অলিম্পিক্সের দলে তিনি ছিলেন প্রদীপ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের (পিকে) মতোই, চুনী ছিলেন না ছাপ্পান্নর মেলবোর্ন অলিম্পিক্সের দলে। তবে, তুলনামূলক শান্ত স্বভাবের কারণেই হয়ত কখনও জাতীয় দলের অধিনায়ক হিসাবে তাঁর নাম আলোচনায় ওঠেনি। তা ছাড়াও, ভারতীয় ফুটবল চালাতেন যাঁরা, অধিনায়ক হিসাবে মোহনবাগান বা হায়দরাবাদের বাইরে যেতে পছন্দ করতেন না তখন, যে-কারণে সমর (বদ্রু) বন্দ্যোপাধ্যায়ও ছাপ্পান্নয় অধিনায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন, প্রথম দলে নিয়মিত জায়গা না পেলেও। ওই ধারায় একমাত্র ব্যতিক্রম পিকে, ষাটে রোম অলিম্পিক্সে যিনি ছিলেন ভারতীয় দলের নেতা।

শারদীয় খেলা পত্রিকায় প্রকাশিত সেই লেখার ছবি

একই রকম বঞ্চিত হতে হয়েছিল পদ্মশ্রী খেতাবের জন্যও। দুঃখ করেই জানাতেন, তাঁর নাম নেওয়া হয়েছিল, দেশের সরকারের পুরস্কারের জন্য ‘পুলিশ ভেরিফিকেশন’-ও হয়েছিল, তবু শেষে তাঁর নাম বাদ দেওয়া হয়, প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর বিরোধিতায় এবং অবশ্যই ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলার হওয়ার অপরাধে। বলরামের এই অভিযোগের কারণও ছিল। তাঁর আগে যে তিন ফুটবলার পদ্মসম্মান পেয়েছিলেন সেই গোষ্ঠ পাল, শৈলেন মান্না এবং চুনী গোস্বামী তিনজনই ছিলেন মোহনবাগানি। পরে বাইচুং ভুটিয়াকেও পদ্মশ্রী দেওয়া হয়েছিল ২০০৮ সালে যখন তিনি মোহনবাগানের ফুটবলার। পিকে এবং সুনীল ছেত্রী এই তালিকায় ব্যতিক্রম।

ইস্টবেঙ্গলি হওয়ার কারণে বঞ্চিত হওয়ার পরও তাই যখন সন্তোষমোহন দেবের তরফে তাঁকে দেওয়া বেনিফিট ম্যাচে টাকার বিনিময়ে খেলতে চেয়েছিল ইস্টবেঙ্গল এবং দাবি করেছিল তাঁর সঙ্গেই প্রশান্ত সিংহকেও দিতে হবে তাঁর নামাঙ্কিত বেনিফিট ম্যাচ থেকে প্রাপ্ত টাকার ভাগ, লালহলুদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা জানিয়েছিলেন অভিমানী বলরাম। সরে গিয়েছিলেন ময়দান থেকেই। উত্তরপাড়ায় গঙ্গার ধারের বাড়িতে নিঃসঙ্গ জীবন বেছে নিয়েছিলেন, শহুরে কোলাহল থেকে দূরে।

৮৬ বছর বয়সে (জন্ম ১৯৩৬ সালে) প্রয়াত হলেন সেকেন্দ্রাবাদের তুলসীদাস বলরাম, বাংলার উত্তরপাড়ায়, কলকাতা ময়দান থেকে খানিকটা দূরে। জীবিত থাকাকালীন যা করতে হয়, মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকারপত্রে সইও করে গিয়েছিলেন। কিন্তু, সেই অঙ্গীকারও অমান্য হল, সৎকার হল যথাযথ বিধিসহকারে। দেখে যেতে পারলেন না বলরাম, তাঁর শেষ ইচ্ছাও অসম্মানিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *