ভারতীয় ফুটবলপ্রেমীর অবশ্যপাঠ্য তালিকায় শীর্ষে

কাশীনাথ ভট্টাচার্য ● কলকাতা

ভারতীয় ফুটবলের সবচেয়ে বড় সমস্যা কী?
প্রয়োজনীয় নথির অভাব, নেই ধারাবাহিক ইতিহাসের লিপিবদ্ধ রূপ। হঠাৎ যদি মনে হয় কোনও একটি বিশেষ ম্যাচের কথা, তার আগে পরে কী কী ম্যাচ হয়েছিল তার ফলাফল পেতে আপনি বহু খোঁজাখুঁজির পরও ব্যর্থ হবেন, প্রায়-নিশ্চিত!
জয়দীপ বসু সম্পাদিত ‘বক্স টু বক্স – সেভেনটি ফাইভ ইয়ার্স অফ দ্য ইন্ডিয়ান ফুটবল টিম’ সেই কাজে পুরোপুরি সফল বলা সম্ভব নয়। কারণ, এই বই ম্যাচ ধরে-ধরে ইতিহাস খোঁজেনি! খুঁজেছে আসলে তার চেয়েও অনেক বেশি। ভারতীয় ফুটবল দলের গত ৭৫ বছরের ‘জার্নি’ ধরে রেখেছে সুদক্ষ সম্পাদনায়, লেখকদের সুখপাঠ্য বিবরণে, দুরন্ত মুন্সিয়ানায়।
পঁচাত্তর বছরের ইতিহাসে সেরা সময় নিঃসন্দেহে প্রথম পঁচিশ। স্বাধীনতার পর, ১৯৪৮ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ লন্ডন অলিম্পিক্সে। সেই ম্যাচ রিপোর্ট ধরা আছে এই বইতে যেখানে দুটি পেনাল্টি নষ্টের কথা, যা অবশ্য প্রচারিত। প্রথম পেনাল্টি মিস করেছিলেন শৈলেন মান্না, পরেরটি মহাবীর প্রসাদ। আর, জানা যাচ্ছে, সাতজন খালি পায়ে খেলেছিলেন সেই ম্যাচে। অর্থাৎ, ভারতের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচে বুটপায়ে খেলা ফুটবলারের সংখ্যা চার। প্রত্যক্ষদর্শীর লেখা বিবরণ। অপপ্রচারের কোনও জায়গাই নেই তাই যে, খালিপায়েই ফুটবল খেলতেন ভারতীয়রা।
তারপর দু-দুবার এশিয়ান গেমসে সোনা যথাক্রমে ১৯৫১ এবং ১৯৬২ সালে। মাঝে ছাপ্পান্ন অলিম্পিক্সে চতুর্থ স্থান। পরে ১৯৭০ এশিয়ান গেমসে ব্রোঞ্জ। ১৯৪৮ থেকে প্রথম পঁচিশ বছর ধরলে ১৯৭২। উল্লেখযোগ্য সাফল্য তারপর সীমাবদ্ধ সাফ গেমস বা সাফ কাপে।
তাই ভারতীয় ফুটবলের আসল গল্পগুলোও ওই প্রথম পঁচিশেই। সরকারি প্রথম ম্যাচের অধিনায়ক নাগাল্যান্ডের তালিমেরান আও (টি আও নামেই পরিচিতি), পরে যিনি চিকিৎসক হিসাবেও স্বনামধন্য। বাবার শেষ ইচ্ছে পূরণ করতে যিনি ফুটবল শেষেই চিকিৎসক হিসাবে ফিরে গিয়েছিলেন নিজের জন্মভূমি নাগাল্যান্ডে। তাঁর জীবন ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বিশদে জানতে ও জানাতে শারদা উগরা চলে গিয়েছিলেন নাগাল্যান্ডে, অজানা এমন কিছু গল্প তুলে এনেছেন যা সত্যিই গল্পের মতো হলেও, আসলে ঘটনা!
সূচিপত্রে চোখ রাখলেই পরিষ্কার, সম্পাদক জয়দীপ এবং সহ-সম্পাদক সায়ন মুখার্জি বই সাজিয়েছেন অত্যন্ত যত্নে। প্রথম খেলা, সোনালি সময়, টি আও, তুলসীদাস বলরাম, জাকার্তায় এশিয়া জয়, রহিম সাহেব আছেন শুরুতে। দ্বিতীয় অংশে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ লেখায় ‘টাকা বনাম জাতীয় দল’, সুধীর কর্মকারের সাক্ষাৎকার এবং চুয়াত্তরে ছোটদের (অনূর্ধ্ব ২১) এশিয়ান ইউথ প্রতিযোগিতা। কথা বলেন না হিসাবে খ্যাতিসম্পন্ন ভারতীয় ফুটবলের সর্বকালের সেরা রাইট ব্যক সুধীরকে এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বলিয়ে-নেওয়ার কৃতিত্ব অবশ্যই দাবি করবেন সাংবাদিক অরুণ সেনগুপ্ত। যেমন সুধীর জানিয়েছেন, এশিয়ান ইউথ প্রতিযোগিতায় খেলতে না-যাওয়ার কথা। ‘তত দিনে সিনিয়র জাতীয় দলে খেলে ফেলেছি। প্রদীপদা (প্রদীপ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়) যদিও জানিয়েছিলেন, গেলে আমিই ক্যাপ্টেন, পরিষ্কার না বলে দিয়েছিলাম। সিনিয়র দলে খেলার পর জুনিয়র টিমে খেলব না, বারবার বলেছিলাম। তাই সেই দলের ক্যাপ্টেন হয়ে সফরে গিয়েছিল চন্দন গুপ্ত।’
১৯৯৮ থেকে ২০২২, তৃতীয় অংশে তিনটি লেখায় ভারতের পারফরম্যান্স, বাইচু্ং ভুটিয়া এবং সুনীল ছেত্রীর সাক্ষাৎকার। পঞ্চমাংশে ভারতের যে রাজ্যগুলি ফুটবলের বিকাশ এ প্রসারে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছে সেই বাংলা, গোয়া, হায়দরাবাদ, পাঞ্জাব, মহীশূর, কেরল, মুম্বই ও নর্থইস্ট নিয়ে আলোচনা। অর্থাৎ, ভারতীয় ফুটবলের কোনও দিকই অনালোচিত নয় এই বইতে।
চতুর্থ অংশ ‘টার্নিং পয়েন্ট’। সম্পাদক জয়দীপ তুলে ধরেছেন শতাব্দীর সেরা ভুলের কথা, যা করেছিল ভারত বা ভারতীয় ফুটবল সংস্থা, ১৯৫০ সালে ব্রাজিল বিশ্বকাপে দল না পাঠিয়ে। সেই অকর্মণ্যতার ইতিহাস! বিশ্বকাপে সুযোগ পেয়েও খেলতে না-যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন যাঁরা, ফুটবলের মসনদে কেনই বা থাকেন! সঙ্গেই সম্পাদক ভেঙেছেন খালিপায়ে ফুটবল সম্পর্কিত মিথ-ও। ভারতীয় ফুটবলের নিয়ামক সংস্থা যত দেরি করেছিল ফুটবলারদের বুট-পরা বাধ্যতমূলক করতে ততই পিছিয়ে পড়েছিল ভারতীয় ফুটবল আন্তর্জাতিক আসরে, নিশ্চিত সম্পাদক। এমনকি, পাকিস্তানও, ভারতের একদিন আগে যে-দেশ স্বাধীন হয়েছিল ব্রিটিশ-বিভাজনে, সেই দেশের ফুটবল সংস্থাও বুটপায়ে খেলা নিশ্চিত করেছিল ভারতের আগে!
২৬৪ পাতার বই-এর উল্লেখযোগ্য সংযোজন গৌতম রায়ের পরিসংখ্যান যেখানে রয়েছে ভারতীয় ফুটবল দলের সংগ্রহে থাকা সমস্ত সাফল্যের দলগত এবং ব্যক্তিগত খতিয়ান।
সব মিলিয়ে জয়দীপ বসু সম্পাদিত ‘বক্স টু বক্স – সেভেনটি ফাইভ ইয়ার্স অফ দ্য ইন্ডিয়ান ফুটবল টিম’ ভারতীয় ফুটবলপ্রেমীর অবশ্যপাঠ্য তালিকায় শীর্ষে থাকবে, এ ব্যাপারে সন্দেহের কোনও অবকাশই নেই।
বক্স টু বক্স – সেভেনটি ফাইভ ইয়ার্স অফ দ্য ইন্ডিয়ান ফুটবল টিম
সম্পাদক – জয়দীপ বসু
সহসম্পাদক – সায়ন মুখার্জি
প্রকাশক – আইএমএইচ, নয়াদিল্লি
মূল্য – ৬৫০ টাকা

● দৈনিক প্রান্তজ্যোতি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *